নব্বইয়ের দশকের শুরুতে, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়ে বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলেই চলছিল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম। তবে নারায়ণগঞ্জ শহরে তখন রাজপথে সক্রিয় ছিল মূলত জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামীর মতো রাজনৈতিক দলগুলো। সে সময় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির রাজনীতির তেমন কোনও কার্যকর উপস্থিতি নারায়ণগঞ্জে ছিল না। রাজপথে দলটির কোনো জোরালো নেতৃত্ব বা সংগঠিত মিছিল চোখে পড়েনি। সাধারণ মানুষের মাঝেও দলটির পরিচিতি ছিল খুবই সীমিত।
এই প্রেক্ষাপটে নারায়ণগঞ্জ শহরের মিশন পাড়া থেকে আমি, জহির আহমেদ সোহেল, প্রথমবারের মতো একটি বিএনপির মিছিলের আয়োজন করি। এই মিছিলটি শহরের রাজনীতিতে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করে এবং সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ধীরে ধীরে মিশন পাড়া ও আশপাশের এলাকার মানুষ, বিশেষ করে তরুণ ছাত্ররা এই আন্দোলনে যুক্ত হতে শুরু করে। এর মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জে বিএনপির সংগঠিত রাজনীতির সূচনা হয়।
পরবর্তীতে দেবক থেকে আবু আল ইউসুফ খান টিপু, সরকার আলম, মাসুদ, মোবারক সহ আরও অনেক সাহসী কর্মী ও ছাত্রনেতাদের সাথে আমরা সম্মিলিতভাবে বিএনপিকে নারায়ণগঞ্জে সংগঠিত ও শক্তিশালী করে তুলি। আমাদের আন্দোলন শুধুই দলীয় ছিল না, এটি ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই, স্বৈরাচারবিরোধী চেতনার বহিঃপ্রকাশ।
আমরা ছাত্ররা তখন বুকের রক্ত দিয়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ি। এই ধারাবাহিক ও আত্মত্যাগমূলক আন্দোলনের ফলেই এক সময় স্বৈরাচার এরশাদের পতন ঘটে। আর তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯১ সালে জাতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় রচিত হয়—ভোট বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। বিপুল পরিমাণ ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করে বিএনপি তখন দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়।
আজ বিএনপির ব্যানারে অনেক বড় বড় নেতা তৈরি হয়েছেন। অনেকে নিজেদের ‘ত্যাগী’, ‘পরীক্ষিত’, ‘নিবেদিত প্রাণ’ নেতা হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। কিন্তু সত্য হলো—এই পরিচয়ের ভিত্তি, সেই রাজপথের বীজ আমরা রোপণ করেছিলাম। আমরা যদি নারায়ণগঞ্জে বিএনপির রাজনীতি প্রতিষ্ঠা না করতাম, যদি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা না রাখতাম—তবে আজ অনেকেই নিজেদের নামের পাশে এইসব উপাধি যুক্ত করতে পারতেন না।
আমরা আমাদের পরিচয়ের জন্য কিছু চাই না, দাবি করি না কোনো পদ বা পুরস্কার। কিন্তু ইতিহাসের সত্যকে বিকৃত করা বা ভুলে যাওয়া অন্যায়। যারা আজ নিজেদের নিবেদিত প্রাণ দাবি করছেন, তাদের প্রতি আহ্বান—আপনারা যদি প্রকৃতই ত্যাগের মূল্য বোঝেন, তবে আমাদের মতো প্রথমদিককার কর্মীদের অবদানও স্বীকার করুন। কারণ আজ আপনারা যাদের পরিচয়ে গর্ব করেন, সেই পরিচয়ের মাটি আমরা তৈরি করে দিয়েছিলাম।
প্রতিবেদক:
জহির আহমেদ সোহেল
সাবেক ছাত্রনেতা,
অগ্রদূত, বিএনপি আন্দোলন, নারায়ণগঞ্জ
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন...